নাউ স্টাডি বাংলা ব্লগে আপনাকে স্বাগতম

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও ইয়াক সুন্দরী

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও ইয়াক সুন্দরী :* 

বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত এই দৃপ্ত শপথে বলিয়ান বাংলাদেশ বিমানবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আসামের দিমাপুরে ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে গঠিত হয়। মাত্র তিনটি বিমান নিয়ে এই বাহিনীর যাত্রা শুরু হয় যার মধ্যে ছিলো দুটি বিমান ডিসি-৩, ডাকোটা এবং একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার। পরবর্তী সময়ে পরাজিত পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া পাচঁটি এফ-৮৬ ই ছিলো বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম জঙ্গী বিমান। এরপর সুদীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা হয়। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একটি সফল বাহিনি। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা দেশে এবং বিদেশে নিজেদের দক্ষতা প্রমান করে আসছে। কিন্ত বিমানবাহিনীর উন্নয়নের পথে এসেছে নানান বাধা। ১৯৯১ সালের সাইক্লোনের ফলে সৃষ্ট জলচ্ছাস ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায় বিমানবাহিনীর অবকাঠামো। ফাইটার, ট্রেনার, হেলিকাপ্টার সহ নষ্ট করে দিয়ে যায় ৪৫ এরও অধিক বিমান। যার মধ্যে ছিল ৪০ টারও বেশি এফ-৬ ফাইটার বিমান এবং ৪ টি সদ্য কেনা এমআই-৮ হেলিকাপ্টার। ১৯৯১ এর ট্র্যাজেডির কারনে তৈরি সেই ঘাটতি এখনো পর্যন্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তানাহলে আজ আমাদের অবস্থান হতে পারতো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার কিংবা ভিয়েতনামের পাশেই।

বর্তমানে বিশ্ব যেখানে সামরিক শক্তিতে অনেক দুর এগিয়ে গিয়েছে, সেখানে আমরা চুপ করে বসে থাকি কিভাবে ? এ কথা মাথায় রেখে সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের লক্ষে সরকার Forces Goal-2030 নামে এক মহা পরিকল্পনা গগ্রহণ করে। সেনা এবং নৌ বাহিনীর পাশাপাশি বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কেনা হয় আধুনিক হেকিকাপ্টার, প্রশিক্ষণ বিমান সহ বিমান বিধ্বংসী মিসাইল। গঠন করা হয়েছে বিমানবাহিনীর নিজস্ব স্পেশাল ফোরস। অতিশীঘ্রই যুক্ত হচ্ছে আধুনিক রাডার সিস্টেম। তার পরও কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়।

বর্তমানে আমাদের বিমান বাহিনীতে আধুনিক মাল্টিরোল যুদ্ধ বিমান বলতে ৮ টি মিগ-২৯ ই একমাত্র ভরশা। মিগ-২৯ বাদে আমাদের কাছে রয়েছে ইন্টারসেপ্টর এফ-৭ যুদ্ধ বিমান। ইন্টারসেপ্টর পর্যাপ্ত থাকলেও, আধুনিক মাল্টিরোল যুদ্ধ বিমানের অভাবে ভোগছি অনেক বছর ধরেই। মাত্র ৮ টা মাল্টিরোল বিমান দিয়ে আর কতদিন !!! এখন তো নতুন কিছু চাই, আধুনিক কিছু চাই। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক ফাইটার বলতে Su-30, Su-35, Erufighter Typhoon, F-16, JAS 39, Rafale কে ধরা হয়ে থাকে। বিমান গুলো যেমন আধুনিক তেমনি চালানো অনেক কঠিন। তাই বলে কি আমরা এধরনের বিমান কিনবনা ? অবশ্যই কিনবো। আগে উন্নত মেশিনের উপর প্রশিক্ষণ, তার পরে কেনাকাটা। কারন এতো আধুনিক মেশিন পরিচালনা করার মত পর্যাপ্ত পাইলট আমাদের নেই। Su-30, Su-35, Erufighter Typhoon, JAS 39, Rafale এর মত বিমান চালানোর জন্য দরকার উচ্চ প্রশিক্ষিত পাইলট, সাথে দরকার অভিজ্ঞতা। আর সেই উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পাইলটদের দৌরতে হয় বিভিন্ন দেশ। খরচ করতে হয় কোটি কোটি টাকা। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ২৪ টি Yak-130 প্রশিক্ষণ বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে দাম কষাকষি শেষে ২৪ থেকে নেমে এসে ১৬ টি বিমান অর্ডার করা হয়। যার প্রথম চালান (৬ টি বিমান) কিছুদিন দেশে এসে পৌঁছয়।

কিন্ত Yak-130 এ আমরা অনেকেই সন্তুষ্ট না। অনেকেই মনের মাঝে কিছু ভুল ধারনা পোষণ করছি। কেও বলছি ফাইটার না কিনে ট্রেনার কেনা হয়েছে কেন ? নিশ্চয়ই গোলমাল আছে !!! কেও ফাইটারের সাথে ট্রেনারের তুলনা করে বলছি ভারতের কারনে Su-30 কিনতে পারিনাই তাই Yak-130 কিনছে, আবার কেও বা বলছি বাংলাদেশের এই বিমানের দরকার কি ? এই বিমান না কিনে Rafale কেনা দরকার ছিল। আমাদের দরকার Su-35 আর সরকার কিনা কিনেছে ইয়াক-১৩০ ??? আসলে ব্যাপারটা অনেকটা ঘোড়া না কিনেই ঘোড়ার গাড়ি কেনার মত। এই সহজ কথাটাই আমরা বোঝতে পারিনা, যে আগে ঘোরা পরে ঘোড়ার গাড়ি। এছারা সামরিক কেনাকাটায় একটা নীতি রয়েছে। টাকা আছে বলেই যে ঐ জিনিশটা কিনতে হবে তা কিন্ত নয়। প্রথমেই দেখতে হবে সেই জিনিশটা আমাদের জন্য উপযুক্ত হবে কিনা। অথবা ঐ জিনিশটা এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন আছে কি না। সামরিক কেনাকাটার সময় হাজারো জিনিশ মাথায় রাখতে হয়। আমাদের আবহাওয়া, ভূপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে, বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে পরেই কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। Yak-130 এর বেলায় ও বেতিক্রম হয়নি।

এবার Yak-130 সম্পর্কে কিছু জানা যাকঃ
Yak-130 হচ্ছে রাশিয়ার তৈরি এক অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ বিমান। রাশিয়ার দাবী অনুযায়ী, বর্তমান পৃথিবীতে এই গোত্রের বিমানের মধ্যে Yak-130 ই সবচেয়ে সেরা। রাশিয়ান বিমান মানেই হচ্ছে অসাধারণ ডিজাইন আর মাত্রারিক্ত ইঞ্জিন শক্তি। কিন্ত প্রশিক্ষণ বিমান বলে Yak-130 এর বেলায় ইঞ্জিনের শক্তির চেয়ে প্রযুক্তির দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। বিমানটির তৈরির কাজ শুরু হয় অনেক আগেই। মানে ১৯৮০ সালের দিকে। লক্ষ্য ছিল এমন একটি প্রশিক্ষণ বিমান বানানোর যার দ্বারা উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন বিমানের প্রশিক্ষণ দেয়া যাবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙ্গন ধরায় মাঝপথে কাজ থেমে যায়। স্নায়ু যুদ্ধের শেষে রাশিয়া এবং ইতালির যৌথ প্রচেষ্টায় আবার এই বিমান তৈরির কাজ শুরু হয়। রাশিয়ানদের তখন অর্থনীতির অবস্থা ছিল শোচনীয়। তখনো ৫০/৫০ শেয়ারে কাজ হচ্ছিল। যেখানে চুক্তি অনুযায়ী ইতালির দায়িত্ব ছিল বিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করার এবং বিশ্ববাজারে বিক্রি করার। কিন্তু রাশিয়ানদের ডিজাইন হাতে পেয়েই ইতালি চোখ উল্টায়। (খাঁটি বাংলায় যাকে পল্টি নেওয়া বোঝায় আরকি) এবং চুক্তি ভঙ্গ করে নিজেরাই বানিয়ে ফেলে M-346 Master নামে একটি প্রশিক্ষণ বিমান। ইতালির এই বেঈমানির কারনে আবারো আটকে যায় রাশিয়ার বিমান তৈরির কাজ। পরবর্তীতে ইয়াকোলভ এর ডিজাইনার আর ইরকুট কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে পুনরায় কাজ শুরু হয়। অবশেষে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে সার্ভিসে আসে ফ্লাইং আইফোন Yak-130

ফ্লাইং আই ফোন হচ্ছে রাশিয়ানাদের আদুরে ডাক। ফ্লাইং আইফোন বলার কারণ হচ্ছে আইফোনের মতই এর ব্যবহার খুব সহজ এবং এর কম্পিউটার আকাশে বৈমানিকের অনেক কাজ কমিয়ে দেয়। এই বিমানের নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত উড্ডয়ন ব্যবস্থা, যাকে ইংরেজিতে বলে ফ্লাই বাই ওয়্যার সিস্টেম। বিশেষ করে বৈমানিকের "পাইলটিং" দক্ষতার অনেক কাজ বিমানের ফ্লাই বাই ওয়্যার করে দিতে সক্ষম। যার ফলে পাইলটরা তার আসল মিশনের দিকে বেশী মনঃসংযোগ করতে পারে। এই বিমানটির আরেকটি অনন্য ব্যপার হল এর কম্পিউটার কে আকাশেই রি-প্রোগ্রামিং করা যায়। যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের তিনটি বিমানের প্রশিক্ষণের প্রোফাইল সেট করা যায়। কখনও এটি Su-30 হিসেবে, কখনও Su-27 হিসেবে আবার কখনও বা F-16 এর মত উড্ডয়ন করা যায়। এখানেই শেষ নয়, যেহেতু এটি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, সেহেতু ভবিষ্যৎ যেকোনো বিমানের প্রোফাইল এতে সেট করে বৈমানিক কে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব। Yak-130 এর আরও একটি বিশেষ দিক রয়েছে। অনন্য এক ডিজাইনের কারনে Yak-130 অনেক কম গতিতে নাক উঁচু অবস্থায় সোজা চলতে পারে। আকাশে তখন এটিকে দেখতে একটি ফণা তোলা সাপের মত দেখায়, যা বর্তমান সময়ে আর কোন প্রশিক্ষণ বিমানের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি।

bangladesh airforce


উচ্চ প্রযুক্তির সাথে আরও একটি বারতি সুবিধাও রয়েছে। যা হল এর বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ বহন ক্ষমতা। যেটি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রেও সমান অবদান রাখতে সক্ষম। বিমানটি তার ৯ টি হার্ড পয়েন্টে ৬৬০০ পাউন্ড ওজনের গোলাবারুদ বহনে সক্ষম। এর মধ্যে রয়েছে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য গাইডেড মিসাইল, আকাশ থেকে ভুমিতে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইল, গাইডেড বোমা, রকেট সহ আরও অনেক কম্বিনেশনের অস্ত্রশস্ত্র। যা একে লাইট ফাইটারের রূপ দান করেছে। তবে সবচাইতে ভাল খবর হচ্ছে, এই বিমান উড্ডয়ন খরচ অনেক কম। ব্যবহার উপযোগিতার বিচারেও অনেক এগিয়ে এর সমসাময়িকদের চেয়ে। এর জন্য আলাদা করে কোন ইন্সটলেশন দরকার পরেনা, সাধাসিধে যেকোন বিমানবন্দর আর রানওয়ে থেকে অপারেশন চালাতে সক্ষম। যা একে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য আদর্শ একটি বিমানে পরিণত করেছে। Yak-130 চালনার মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের পাইলটরা Su-30, Su-35, Erufighter Typhoon, Rafale চালনার মত দক্ষ হয়ে উঠবেন। এমনকি কি তারা পঞ্চম প্রযন্মের স্টিলত বিমান সম্পর্কেও ধারনা লাভ করবেন।

এই Yak-130 বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। এতেই ধারনা পাওয়া যায় বিমানবাহিনীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে !!! বোঝাই যাচ্ছে বাংলার আকাশ প্রহরী হতে চলেছে Su-30, Su-35 অথবা Erufighter Typhoon, Rafale কিংবা এর সমানের যুদ্ধ বিমান। 
Share This