নক্ষত্রের মেঘ
--------------
জুতাটা খুলে ঢুকতে গিয়ে থমকে যায় নুহা। ভেতরে বড় চাচার গলা শোনা যাচ্ছে। উহু! তাহলে তো মোটেও এইদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। এই বড় চাচার সব ভালো। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। সেটা হলো- প্রশ্ন করার বাতিক। কে কই গেল, কার সাথে গেল, কেন গেল-আউফ! নুহা আর ভাবতে পারে না। তবে এখন আর চাচা ওকে কিছুই বলতে পারবে না, ভাবতেই মুচকি হাসি ফোটে ওর মুখে। আবার একটু মন খারাপও হয়। ও ঠিক বুঝতে পারে না।
হালকা পায়ে দৌড়ে ও ড্রয়িংরুমের পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। যাক! অনেকদিন পড় বাড়ি ফিরে স্বস্তি লাগছে। সোজা মায়ের রুমে উঁকি দিলো নুহা। ঘর কেমন অন্ধকার। তার মধ্যেই মাকে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আস্তে করে এক পা রাখতেই মা কথা বলে উঠলেন
- কে? নুহা?
আজব তো! মা বুঝল কীভাবে সে এসেছে। ধ্যাত! মাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টাটা পুরোই মাঠে মরে ভূত হয়ে গেল!
- কে? নুহা, তুই? মা আবার বলেন
- হু
- এদিক আয়
নুহা সামনে এসে দাঁড়ায়। বহু কষ্টে শোওয়া থেকে ওঠেন ওর মা। তারপর টেনে ওকে বিছানায় বসান।
- পাজি মেয়ে, এত দিন পড় কেউ বাড়ি আসে? বলেই নুহার বাম কান টেনে ধরলেন
- আআআআআ... মা আস্তে...লাগছে তো... উহুহুহু...
- পিটিয়ে গায়ের ছাল তুলে দেব
- সরি... সরি... আর করব না...এবারের মতো ছেড়ে দাও
- মনে থাকবে?
- হু...হু... ১০০ বার থাকবে। বাপরে! কান শিওর টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। নুহা সমানে কান ডলে।
মা সেদিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে ওকে বুকে জাপটে ধরেন। আহ! মার শরীরের গন্ধ! কতদিন এই গন্ধটা পায়নি সে। ইশ! যাওয়ার সময় গন্ধটা বোতলে করে নিয়ে যেতে পারলে কী ভালই না হতো!
মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর খুব আরামে ঘুমাচ্ছেন। নুহা এবার তার রুমে চলে যায়। সব আগের মতই আছে। ওর পড়ার টেবিল, শেলফে রাখা বই, ওর মিকি মাউসওয়ালা দেয়াল ঘড়ি... সব আগের মতো।
ধপাস করে খাটে শুয়ে পরে সে। আলসেমি করে আর জানলার পর্দা সরায় না। থাকুক, মাঝে মাঝে অন্ধকারই ভালো লাগে। হঠাৎঘরের বাইরে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। নুহা জানে, ওটা বাবা। এটা ওর এক গুণ। বলা যায়, হিডেন ট্যালেন্ট! বাসার সবার পায়ের আওয়াজ চেনে সে। জুতার শব্দ শুনলেই বুঝতে পারে কে কোনটা! বাবা তো একদিন রসিকতা করে বলেছিলেন তার মেয়ে নাকি- পদশব্দবিদ!
নুহা হেসে ফেলে। বাবা ওর ঘরে আসে ঢোকেন। মনে হল কিছু একটা বলবেন। কিন্তু না! কেমন অদ্ভুতভাবে আবার বেরিয়ে গেলেন। বেচারা বাবা! নিজের মনের কথা খুব কম সময়ই উনি বলতে পেরেছেন। ওর বড় বোন মাহা বাবাকে বেশ ভয়ই পায়। কিন্তু নুহার ওসব বালাই নেই। নির্দ্বিধায় সে বাবার গলা ধরে ঝুলে পরে। যখন যা মনে চায় আবদার করে ফেলে...
- বাবা, এবার ঈদে আমার লাল জামা চাই
- বাবা, আমাকে পাঁচশ টাকা দাও তো। বন্ধুদের খাওয়াব। উফ... জলদি দাও... ভার্সিটি যাবো... দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাবাআআ... ওর ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই থাকে...
নুহা ওর ডায়রিটা খুঁজে পাচ্ছে না। কই গেল! আজব! ড্রয়ারের এক কোণেই তো রাখা ছিল। নিল কে! নুহা খুব বিরক্ত হয়। ওর ব্যক্তিগত জিনিসে কেউ হাত দিলে ওর মোটেও ভালো লাগে না। সেটা বাসার যে কেউই হোক না কেন। কোথায় যে গেল ডায়েরিটা! ইশ! নুহা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে...
বাগানের দোলনাটা অল্প অল্প দুলছে। সন্ধ্যার এই সময়টায় হাসিব এখানে চুপচাপ বসে থাকে। সঙ্গে থাকে হালকা কমলা রঙের একটা ডায়েরি। ওটার প্রতিটা পাতা ওর মুখস্ত। প্রতিটা লাইন... প্রতিটা শব্দ। তাও পুরনো হয় না। প্রতিদিন সে বিকেল বেলা ডায়েরিরা নিয়ে বসে। সন্ধ্যায় বন্ধ করে। কী মনে করে... একটা পাতা খোলে ও... আবছা আলোয় অক্ষরগুলো ভাসতে থাকে চোখের সামনে...
‘আমার খুব শখ, একদিন মেঘের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকার। মাঝে মাঝে এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে লাফিয়ে বেড়াব। ইশ! যদি পারতাম! কেন এমন হয় না! চাইলেই কেন মেঘদের ছোঁয়া যায় না! ’
‘তোমাকে দুইদিন হল দেখি না। আজকে দুই শালিক দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে কী উইশ করলাম জানো? তোমার সাথে যেন আজকে দেখা হয়। ওমা! সত্যিই তোমার সাথে আমার দেখা হয়ে গেল! অনেক চেষ্টা করলাম তোমার ওপর রাগ করতে। কিন্তু তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এমন হাসি দিলে, আমার একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল। ধ্যাত!
শালিক পাখি, আমি তোমাদের এতগুলো ভালোবাসি।’
‘আজকে মাহার সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে। দোষটা অবশ্যই আমারই। ওকে খ্যাপাতে গিয়ে একটু বেশি খেপিয়ে দিয়েছি। সরি, সিস। মুখে তো বলতে পারব না। ভাবছি, একটা সরি লেখা কার্ড বানাব।’
‘যত দূরে থাক ফের দেখা হবে- বইটা পড়লাম। দারুণ বই! ট্র্যাজিক বই পরে ভেউভেউ করে কাঁদার অভ্যাস আমার বহু পুরনো। এবারো কেঁদেছি। হাসিবকে গল্পটা খুব শোনাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ফাজিল ছেলে, বললেই খ্যাক খ্যাক করে হাসা শুরু করবে। ধুরর...ওকে বলাই যাবে না...
উমমম...আচ্ছা...আমি যদি কখনো আবীরের (গল্পের নায়ক) মতো রাতের তারা হয়ে যাই, তখনও কী হাসিব আমাকে সায়ন্তির (নায়িকা) মতো আমাকে ভালোবাসবে?’
ধুপ করে ডায়েরিটা বন্ধ করে দেয় হাসিব। চশমার কাঁচটা ঘোলা হয়ে আসে। হঠাৎ কেন জানি মনে হয়, নুহা ওর পাশে বসে আছে। হাসিব কাঁদে... কাঁদতেই থাকে... কাঁদতেই থাকে...
নুহার কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। হাসিব কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। নুহা শক্ত করে ওর হাত ধরে। টুপটুপ করে সেখানে পানির ফোঁটা পরে। নুহার নিজেকে অসহায় লাগে। সৃষ্টিকর্তা তাকে একদিনের সময় দিয়েছেন... মনে হচ্ছে এই একদিনটা আর শেষ না হোক... শেষ না হোক...
দুই বছর আগে প্রতিদিনের মতই বিকেলে ভার্সিটি শেষে বের হয়েছিল নুহা। এর মধ্যে মা ফোন দিলেন।
- কই রে তুই?
- এইতো মা, ক্লাস সবে শেষ হল
- ও। আচ্ছা আসার সময় তোর বাবার প্রেশারের ওষুধটা নিয়ে আসিস। তোর বাবার মনেই ছিল না, ওষুধ শেষ। কী যে করে না!
- হি হি হি... ভালো তো... এগুলো না করলে তুমি টেনশন করতে কী করতে?
- ফাজলামো করবি না, খবরদার। তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। আর সাবধানে আসিস।
- আচ্ছা বাবা... আচ্ছা... ফোনের লাইন কেটে যায়...
না। নুহা পারেনি সাবধানে বাড়ি ফিরতে। ওষুধ কিনতে যাওয়ার সময় রং সাইড থেকে একটা গাড়ি ওকে ধাক্কা মারে। নুহা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। চোখের সামনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য শুধু বাবাকে দেখেছে... মাকে দেখেছে... মাহা... হাসিব... তারপর...
নুহা অনেকদিন কেঁদেছে। ওপরে বসে ও সব খবরই পায়। কিন্তু কেন জানি খুব মায়ের বুকে লুকোতে আর বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। মাহার সাথে মিছেমিছি ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে। ওর মৃত্যুর পড় মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বাবা আরও চুপচাপ। পুরো বাড়ির সমস্ত সুখ কেউ যেন হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিলো। আর বোকা মেয়ে মাহা... প্রতিদিন ওর রুম গুছিয়ে রাখে। যেন নুহা আসলে চেঁচামেচি না করে। উফ! এত ভালো কেন ওর বোনটা? এই জীবনে একটাই পচা কাজ করেছে সে, ওর ডায়রিটা গিয়ে হাসিবকে দিয়ে দিয়েছে। কোনো মানে হয়?
আর হাসিব! এই বোকা ছেলেটার জন্য ওর খুব চিন্তা হয়। উপন্যাসে ওসব দেবদাসগিরি চলে। বাস্তবে এমন হতে হবে নাকি? নুহার বুঝি কষ্ট হয় না!
নুহা ভেউভেউ কর কাঁদে। পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু পারে না। এখনই যে ওকে চলে যেতে হবে! মেঘের ওপারে... মেঘ থেকে মেঘে...
--------------
জুতাটা খুলে ঢুকতে গিয়ে থমকে যায় নুহা। ভেতরে বড় চাচার গলা শোনা যাচ্ছে। উহু! তাহলে তো মোটেও এইদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। এই বড় চাচার সব ভালো। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। সেটা হলো- প্রশ্ন করার বাতিক। কে কই গেল, কার সাথে গেল, কেন গেল-আউফ! নুহা আর ভাবতে পারে না। তবে এখন আর চাচা ওকে কিছুই বলতে পারবে না, ভাবতেই মুচকি হাসি ফোটে ওর মুখে। আবার একটু মন খারাপও হয়। ও ঠিক বুঝতে পারে না।
হালকা পায়ে দৌড়ে ও ড্রয়িংরুমের পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। যাক! অনেকদিন পড় বাড়ি ফিরে স্বস্তি লাগছে। সোজা মায়ের রুমে উঁকি দিলো নুহা। ঘর কেমন অন্ধকার। তার মধ্যেই মাকে শুয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আস্তে করে এক পা রাখতেই মা কথা বলে উঠলেন
- কে? নুহা?
আজব তো! মা বুঝল কীভাবে সে এসেছে। ধ্যাত! মাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টাটা পুরোই মাঠে মরে ভূত হয়ে গেল!
- কে? নুহা, তুই? মা আবার বলেন
- হু
- এদিক আয়
নুহা সামনে এসে দাঁড়ায়। বহু কষ্টে শোওয়া থেকে ওঠেন ওর মা। তারপর টেনে ওকে বিছানায় বসান।
- পাজি মেয়ে, এত দিন পড় কেউ বাড়ি আসে? বলেই নুহার বাম কান টেনে ধরলেন
- আআআআআ... মা আস্তে...লাগছে তো... উহুহুহু...
- পিটিয়ে গায়ের ছাল তুলে দেব
- সরি... সরি... আর করব না...এবারের মতো ছেড়ে দাও
- মনে থাকবে?
- হু...হু... ১০০ বার থাকবে। বাপরে! কান শিওর টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। নুহা সমানে কান ডলে।
মা সেদিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে ওকে বুকে জাপটে ধরেন। আহ! মার শরীরের গন্ধ! কতদিন এই গন্ধটা পায়নি সে। ইশ! যাওয়ার সময় গন্ধটা বোতলে করে নিয়ে যেতে পারলে কী ভালই না হতো!
মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর খুব আরামে ঘুমাচ্ছেন। নুহা এবার তার রুমে চলে যায়। সব আগের মতই আছে। ওর পড়ার টেবিল, শেলফে রাখা বই, ওর মিকি মাউসওয়ালা দেয়াল ঘড়ি... সব আগের মতো।
ধপাস করে খাটে শুয়ে পরে সে। আলসেমি করে আর জানলার পর্দা সরায় না। থাকুক, মাঝে মাঝে অন্ধকারই ভালো লাগে। হঠাৎঘরের বাইরে পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। নুহা জানে, ওটা বাবা। এটা ওর এক গুণ। বলা যায়, হিডেন ট্যালেন্ট! বাসার সবার পায়ের আওয়াজ চেনে সে। জুতার শব্দ শুনলেই বুঝতে পারে কে কোনটা! বাবা তো একদিন রসিকতা করে বলেছিলেন তার মেয়ে নাকি- পদশব্দবিদ!
নুহা হেসে ফেলে। বাবা ওর ঘরে আসে ঢোকেন। মনে হল কিছু একটা বলবেন। কিন্তু না! কেমন অদ্ভুতভাবে আবার বেরিয়ে গেলেন। বেচারা বাবা! নিজের মনের কথা খুব কম সময়ই উনি বলতে পেরেছেন। ওর বড় বোন মাহা বাবাকে বেশ ভয়ই পায়। কিন্তু নুহার ওসব বালাই নেই। নির্দ্বিধায় সে বাবার গলা ধরে ঝুলে পরে। যখন যা মনে চায় আবদার করে ফেলে...
- বাবা, এবার ঈদে আমার লাল জামা চাই
- বাবা, আমাকে পাঁচশ টাকা দাও তো। বন্ধুদের খাওয়াব। উফ... জলদি দাও... ভার্সিটি যাবো... দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাবাআআ... ওর ঘ্যানর ঘ্যানর চলতেই থাকে...
নুহা ওর ডায়রিটা খুঁজে পাচ্ছে না। কই গেল! আজব! ড্রয়ারের এক কোণেই তো রাখা ছিল। নিল কে! নুহা খুব বিরক্ত হয়। ওর ব্যক্তিগত জিনিসে কেউ হাত দিলে ওর মোটেও ভালো লাগে না। সেটা বাসার যে কেউই হোক না কেন। কোথায় যে গেল ডায়েরিটা! ইশ! নুহা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে...
বাগানের দোলনাটা অল্প অল্প দুলছে। সন্ধ্যার এই সময়টায় হাসিব এখানে চুপচাপ বসে থাকে। সঙ্গে থাকে হালকা কমলা রঙের একটা ডায়েরি। ওটার প্রতিটা পাতা ওর মুখস্ত। প্রতিটা লাইন... প্রতিটা শব্দ। তাও পুরনো হয় না। প্রতিদিন সে বিকেল বেলা ডায়েরিরা নিয়ে বসে। সন্ধ্যায় বন্ধ করে। কী মনে করে... একটা পাতা খোলে ও... আবছা আলোয় অক্ষরগুলো ভাসতে থাকে চোখের সামনে...
‘আমার খুব শখ, একদিন মেঘের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকার। মাঝে মাঝে এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে লাফিয়ে বেড়াব। ইশ! যদি পারতাম! কেন এমন হয় না! চাইলেই কেন মেঘদের ছোঁয়া যায় না! ’
‘তোমাকে দুইদিন হল দেখি না। আজকে দুই শালিক দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে কী উইশ করলাম জানো? তোমার সাথে যেন আজকে দেখা হয়। ওমা! সত্যিই তোমার সাথে আমার দেখা হয়ে গেল! অনেক চেষ্টা করলাম তোমার ওপর রাগ করতে। কিন্তু তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এমন হাসি দিলে, আমার একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল। ধ্যাত!
শালিক পাখি, আমি তোমাদের এতগুলো ভালোবাসি।’
‘আজকে মাহার সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে। দোষটা অবশ্যই আমারই। ওকে খ্যাপাতে গিয়ে একটু বেশি খেপিয়ে দিয়েছি। সরি, সিস। মুখে তো বলতে পারব না। ভাবছি, একটা সরি লেখা কার্ড বানাব।’
‘যত দূরে থাক ফের দেখা হবে- বইটা পড়লাম। দারুণ বই! ট্র্যাজিক বই পরে ভেউভেউ করে কাঁদার অভ্যাস আমার বহু পুরনো। এবারো কেঁদেছি। হাসিবকে গল্পটা খুব শোনাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ফাজিল ছেলে, বললেই খ্যাক খ্যাক করে হাসা শুরু করবে। ধুরর...ওকে বলাই যাবে না...
উমমম...আচ্ছা...আমি যদি কখনো আবীরের (গল্পের নায়ক) মতো রাতের তারা হয়ে যাই, তখনও কী হাসিব আমাকে সায়ন্তির (নায়িকা) মতো আমাকে ভালোবাসবে?’
ধুপ করে ডায়েরিটা বন্ধ করে দেয় হাসিব। চশমার কাঁচটা ঘোলা হয়ে আসে। হঠাৎ কেন জানি মনে হয়, নুহা ওর পাশে বসে আছে। হাসিব কাঁদে... কাঁদতেই থাকে... কাঁদতেই থাকে...
নুহার কান্না পাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। হাসিব কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। নুহা শক্ত করে ওর হাত ধরে। টুপটুপ করে সেখানে পানির ফোঁটা পরে। নুহার নিজেকে অসহায় লাগে। সৃষ্টিকর্তা তাকে একদিনের সময় দিয়েছেন... মনে হচ্ছে এই একদিনটা আর শেষ না হোক... শেষ না হোক...
দুই বছর আগে প্রতিদিনের মতই বিকেলে ভার্সিটি শেষে বের হয়েছিল নুহা। এর মধ্যে মা ফোন দিলেন।
- কই রে তুই?
- এইতো মা, ক্লাস সবে শেষ হল
- ও। আচ্ছা আসার সময় তোর বাবার প্রেশারের ওষুধটা নিয়ে আসিস। তোর বাবার মনেই ছিল না, ওষুধ শেষ। কী যে করে না!
- হি হি হি... ভালো তো... এগুলো না করলে তুমি টেনশন করতে কী করতে?
- ফাজলামো করবি না, খবরদার। তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। আর সাবধানে আসিস।
- আচ্ছা বাবা... আচ্ছা... ফোনের লাইন কেটে যায়...
না। নুহা পারেনি সাবধানে বাড়ি ফিরতে। ওষুধ কিনতে যাওয়ার সময় রং সাইড থেকে একটা গাড়ি ওকে ধাক্কা মারে। নুহা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। চোখের সামনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য শুধু বাবাকে দেখেছে... মাকে দেখেছে... মাহা... হাসিব... তারপর...
নুহা অনেকদিন কেঁদেছে। ওপরে বসে ও সব খবরই পায়। কিন্তু কেন জানি খুব মায়ের বুকে লুকোতে আর বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। মাহার সাথে মিছেমিছি ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে। ওর মৃত্যুর পড় মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বাবা আরও চুপচাপ। পুরো বাড়ির সমস্ত সুখ কেউ যেন হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিলো। আর বোকা মেয়ে মাহা... প্রতিদিন ওর রুম গুছিয়ে রাখে। যেন নুহা আসলে চেঁচামেচি না করে। উফ! এত ভালো কেন ওর বোনটা? এই জীবনে একটাই পচা কাজ করেছে সে, ওর ডায়রিটা গিয়ে হাসিবকে দিয়ে দিয়েছে। কোনো মানে হয়?
আর হাসিব! এই বোকা ছেলেটার জন্য ওর খুব চিন্তা হয়। উপন্যাসে ওসব দেবদাসগিরি চলে। বাস্তবে এমন হতে হবে নাকি? নুহার বুঝি কষ্ট হয় না!
নুহা ভেউভেউ কর কাঁদে। পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু পারে না। এখনই যে ওকে চলে যেতে হবে! মেঘের ওপারে... মেঘ থেকে মেঘে...